বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের আলোচনার সুবিধার্থে ইতিহাসের যে যুগবিভাগ করা হয়েছে,সেখানে খ্রিষ্টীয় ১০-১২শতক সময়কালকে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনকাল হিসেবে ধরা হয়েছে। এবার বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনকালের যে একমাত্র সাহিত্য নিদর্শন পাওয়া যায় তা হলো চর্যাপদ। এবার চর্যাপদ জিনিসটা আসলে কী? কে বা কারা চর্যাপদ রচনা করেছিলেন, চর্যাপদে আসলে ঠিক কী রয়েছে এবং চর্যাপদ সম্পর্কিত অন্যান্য যে বিষয়গুলো রয়েছে- সেটাই আমাদের মূল আলোচ্য বিষয়. আশা করি সাহিত্যের ইতিহাসের এই পর্বটি পড়তে তোমাদের ভালো লাগবে।
▪ চর্যাপদ আবিষ্কারের ইতিহাস:-
চর্যাপদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার আগে আমাদের এটা জানা প্রয়োজন যে হঠাৎ করে কিভাবে চর্যাপদ আমাদের সামনে আসলো বা কিভাবে এই চর্যাপদকে উদ্ধার করা হলো। পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ধারনা ছিল যে বাংলার বৌদ্ধ সাধক এবং তাদের শিষ্যরা কোনো এক কারণে তাদের বৌদ্ধ পুঁথি এবং গ্রন্থ নিয়ে নেপাল,তিব্বত, ভুটান মায়ানমারে চলে গিয়েছিলেন। এই ধারণার হাত ধরে পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় বৌদ্ধ লোকাচার সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য মোট চার বার নেপালে গিয়েছিলেন। ১৯০৭ সালে যখন তিনি তৃতীয়বারের জন্য নেপালে গিয়েছিলেন,তখন নেপালের রাজ গ্রন্থাগারে একটি পুঁথি খুঁজে পেয়েছিলেন। পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের খুঁজে পাওয়া সেই পুঁথিটিই আমরা এখন চর্যাপদ নামে জানি। পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় চর্যাপদের যে পুথি আবিষ্কার করেছিলেন সেখানে মোট ৪৬½টি পদ ছিল। তবে প্রবোচন্দ্র বাগচী চর্যাপদের যে তিব্বতি অনুবাদ আবিষ্কার করেন সেখানে আবার ৫১ টি পদ পাওয়া যায়।
• হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় চর্যাপদের যে পুঁথি খুঁজে পেয়েছিলেন সেই পুথীর ভেতরে একটি চিরকুটের চর্চাচর্যবিনিশ্চয় নামটি খুঁজে পাওয়া যায়। মনে করা হয় এটিই চর্যাপদের আদি নাম।
এখানে মনে রাখবে চর্যাপদের তিব্বতি অনুবাদক ছিলেন মুনি দত্ত। যাইহোক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় চর্যাপদের যে পুঁথি আবিষ্কার করেন সেগুলো তিনি ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে 'হাজার বছরের পুরান বৌদ্ধ গান ও দোহা' এই নামে প্রকাশ করেন।
• চর্যাপদের রচনা কালঃ
• চর্যার রচনাকাল নিয়ে বিতর্ক আছে। গ্রন্থটির আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, গ্রন্থের ব্যাখাকার ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও ড. সুকুমার সেন প্রমুখ পণ্ডিতগণ চর্যাগীতি গুলিকে সাধারণ ভাবে দশম ও দ্বাদশ শতকের অন্তবর্তীকালের রচনা বলে মনে করেন।
• এছাড়াও ভাষাচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের তাঁর অরিজিন এন্ড ডেভেলপমেন্ট অফ বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ (ODBL) গ্রন্থে এটা প্রমাণ করেছেন যে চর্যাপদ হলো বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন।
• অন্যদিকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যারচনার কাল সীমাকে আরও প্রাচীন ধরে নিয়ে চর্যাগীতিগুলিকে অষ্টম শতক থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তীকালের রচনা বলে মনে করেন। অবশ্য চর্যাগীতির অনুলেখনের কালসীমা সম্পর্কে ড. সুকুমার সেনের মন্তব্য অন্যরকম। তিনি অনুলেখনের শৈলীতে পঞ্চদশ শতকের লেখন পদ্ধতির মিল খুঁজে পেয়েছেন কোনো কোনো চর্যার অনুলেখনে।
▪ চর্যাপদ কারা রচনা করেছিলেন?
আমরা যে চর্যাপদের ইতিহাস পড়ছি সেই চর্যাপদ কিন্তু কোনো একজন ব্যক্তি বা কবি রচনা করেননি। মনে করা হয় মোট ২৪জন বৌদ্ধ সহজিয়া সাধাক / কবি মিলে চর্যাপদ রচনা করেছিলেন। কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কাহ্ন পাদ, ঢেন্ডন পাদ, লুই পাদ, ভুসুক পাদ প্রমুখ। চর্যাপদের কবিদের মধ্যে কাহ্ন পাদ সবচেয়ে বেশি পদ রচনা করেছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে; কবিদের নামের শেষে এখানে যে 'পাদ' শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে তা মূলত তাদের সম্মানসূচক অবস্থানকে বোঝায়।
▪ চর্যাপদে আসলে কী রয়েছে? বা চর্যাপদের বিষয়বস্তু কী?
অধ্যাপক নীলরতন সেন তাঁর চর্যাগীতিকোষ গ্রন্থের ভূমিকায় চর্যাপদের বিষয়বস্তু কিছুটা এইভাবে উল্লেখ করেছেন-চর্যাগীতের বিষয়বস্তু মূলত বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্মভিত্তিক। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, চর্যাপদ কিন্তু রচিত হয়েছিল কিন্তু আলো আঁধারি ভাষা বা সন্ধ্যা ভাষায়।
• যাইহোক সহজ ভাষায় বলতে গেলে ধর্মীয় সংগীত এবং ধর্মীয় সাধনাই এখানে মূল আলোচ্য বিষয়। অন্যদিকে চর্যাপদ যেহেতু বিশুদ্ধ সাহিত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে রচনা করা হয়নি ; সেই কারণে আলো-আধারী ভাষায় চর্যাপদে হাজার বছর আগেকার সমাজচিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। চর্যাপদে মূলত পূর্বভারতীয় প্রাকৃতিক বর্ণনা এবং তৎকালীন নর-নারীর জীবনের ও এই অঞ্চলের মানব সমাজের নানা চিত্র ফুটে উঠেছে।
• বিভিন্ন সামাজিক রীতিনীতি উৎসবের চিত্র ফুটে উঠেছে চর্যাপদে। চর্যাপদের গীত থেকে বোঝা যায় সেই সময়ের গ্রামীণ সমাজ ছিল মুখ্যত কৃষিভিত্তিক এবং গ্রামগুলি অধিকাংশ নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল। সেই কারনে তখন যাতায়াতের মুখ্য বাহন ছিল নৌকা। চর্যাপদে কিন্তু এই নৌকা সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া যায়। হাল, লগি, গলুই, পাল, গুণ, নোঙর প্রভৃতি নৌকার নানা অংশ ও নৌকা চালানোর কিছু পদ্ধতিও বর্ণিত হয়েছে।
• চর্যাপদের গীত থেকে বোঝা যায় সেই সময় সমাজে বর্ণভেদ প্রথা স্পষ্ট ছিল ছিল। সমাজের উচ্চবিত্তরা বসবাস করত গ্রামের কেন্দ্রস্থলে এবং ডোম, চণ্ডাল, শবর প্রভৃতি নিম্নজাতের লোকেরা গাঁয়ের প্রান্তে বাস করত।
• চর্যাপদ থেকে তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন সামাজিক পেশার ভিত্তিতে এটা বলতে পারি যে সেই সময়ের মানুষের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। তখন কৃষি মুখ্য জীবিকা ছিল, অন্যান্য জীবিকার মধ্যে মাঝির কাজ, তাঁত বোনা, ধুনুরির কাজ, বন্য হরিণ শিকার, কাঠুরের কাজ, ডালা, কুলা তৈরি প্রভৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়। একশ্রেণির স্ত্রীলোকের মধ্যে নৃত্যগীত, মদ তৈরি করে বিক্রয় করা, ইন্দ্রজাল দেখানো, এমনকি বারাঙ্গনাবৃত্তি অবলম্বন জীবিকার উপায় রূপে গণ্য হত।
• চর্যাপদের ফুটে উঠেছে সেই সময়ের মানুষের আহারের ইতিহাস। তখন মানুষের প্রধান খাদ্য ছিল ভাত। তবে ভাত ছাড়াও মাছ, মাংস তাদের খাদ্য তালিকায় ছিল। এছাড়াও আচার অনুষ্ঠানে মধ্যপান এবং পানের ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায় চর্যাগীতিতে।
** পরীক্ষায় চর্যাপদ সম্পর্কিত কী প্রশ্ন আসতে পারে?
১) চর্যাগীতির আবিষ্কর্তা, আবিষ্কারকালও গ্রন্থনাম সম্পর্কে আলোচনা করো।
২) বাংলা সাহিত্যে চর্যাগীতি গ্রন্থের গুরুত্ব নির্দেশ করো।
৩) চর্যাগীতিগুলিতে প্রতিফলিত বাঙালির সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের পরিচয় দাও।
Post a Comment