১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ ও ফলাফল! এমন নোট কোনো বইতে পাবেনা 📝

WB Class 10 History : Major Causes And Effects Of 1857 Sepoy Mutiny (Sipahi Bidroho)

wb-class-10-history-causes-and-effects-of-1857-sepoy-mutiny-in-bengali

দশম শ্রেণির ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায় সঙ্ঘবদ্ধতার গোড়ার কথায় তোমাদের ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহ সম্পর্কে পড়তে হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাধ্যমিক পরীক্ষায় সিপাহী বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে প্রশ্ন হয়ে থাকে তব সেই বিষয়ে যাওয়ার আগে আমাদের অবশ্যই সিপাহী বিদ্রোহের প্রকৃত কারণ এবং ফলাফল সম্পর্কে জানতে হবে। আজকেই ব্লg পোস্টে মাধ্যমিক ইতিহাসের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আমরা খুবই বিস্তারিতভাবে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহের প্রধান কারণ এবং ফলাফল সমূহ উল্লেখ করেছি. আশা করি এই লেখনী পড়ে তোমাদের মনে একটা স্পষ্ট ধারণা তৈরি হবে।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসন ক্ষমতা দখল করেছিল ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের পর। এই যুদ্ধ সমাপ্তির ১০০ বছর পর অর্থাৎ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় শুরু হয় সিপাহী বিদ্রোহ। মূলত ভারতীয়দের প্রতি ইন্ডিয়া কোম্পানির বিভিন্ন ধরনের শাসন, শোষণের ফলস্বরূপই এই মহাবিদ্রোহ বা জাতীয় বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। 

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ২৬শে ফেব্রুয়ারি মুর্শিদাবাদের বহরমপুর সেনানিবাসের সিপাহীদের মধ্যে প্রথম বিক্ষোভ দেখা গিয়েছিল। এরপর ২৯ শে মার্চ ব্যারাকপুর সেনানিবাসের ৩৪ নং নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির সিপাহী মঙ্গল পান্ডে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ শে মার্চ বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এরপর মঙ্গল পান্ডেকে গ্রেফতার করা হয় এবং বিচারে তার ফাঁসি হয় এবং এই ভাবেই মঙ্গল পান্ডে হয়ে ওঠেন সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম শহীদ। এর পরেই ১০ই মে বিরাট এবং ১১ ই মে দিল্লি সেনানিবাসে এই সিপাহী বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে এবং সিপাহী বিদ্রোহ ব্যাপকভাবে শুরু হয়ে যায়।

*সিপাহী বিদ্রোহের কারণসমূহঃ-

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে যে সিপাহী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল সেই সিপাহী বিদ্রোহের কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণ ছিল না। অনেকে সিপাহী বিদ্রোহের কারণ হিসেবে সিপাহীদের নিজস্ব সামরিক কারণকে উল্লেখ করলেও সিপাহী বিদ্রোহের পেছনে রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক কারণসমূহ লুকিয়ে ছিল।

* সিপাহী বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণঃ

সিপাহী বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে আমরা সামরিক কারণগুলোকে চিহ্নিত করতে পারি। ১৮৫৭ সালে যেহেতু সিপাহী বিদ্রোহ সিপাহীদের দ্বারাই শুরু হয়েছিল সেই কারণে আমরা প্রথমেই বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণগুলি কে চিহ্নিত করতে পারি। সিপাহী বিদ্রোহের পেছনে যে প্রত্যক্ষ সামরিক কারণ গুলো লুকিয়ে ছিল তা হল-

১) ভারতীয় হিন্দু এবং মুসলিম সিপাহীদের কম বেতন প্রদান, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে তাদেরই ঠেলে দেওয়া, তাদের অবজ্ঞার চোখে দেখা, ইউরোপিয়ান সৈন্যদের অধিক সুবিধা প্রদান এবং ভারতীয়দের প্রতি অমানবিক অশালীন আচরণ কালাপানি পার করার মতো ব্যাপার ভারতীয় সিপাহীদের যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষুব্ধ করে।

২) এছাড়াও ভারতীয় হিন্দু এবং মুসলিম সিপাহীদের মধ্যে জেনে বুঝে গরু এবং শুকরের চর্বি মিশ্রিত ইনফিল্ড রাইফেলের প্রচলন ছিল সিপাহী বিদ্রোহের মুখ্য সামরিক কারণ।

* সিপাহী বিদ্রোহের পরোক্ষ কারণ সমূহঃ 

অন্যদিকে সিপাহী বিদ্রোহের পরোক্ষ কারণ হিসেবে আমরা রাজনৈতিক সামাজিক ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক কারণ সমূহ কে উল্লেখ করতে পারি।

▪ সিপাহী বিদ্রোহের সামাজিক কারণসমূহঃ

ব্রিটিশরা সবসময় ভারতীয়দের নিচ, অযোগ্য বলে মনে করতো এবং তাদের অবজ্ঞার চোখে 'নেটিভ' বলে সম্বোধন করতো। ভারতীয়দের প্রতি ব্রিটিশদের এরূপ ব্যবহার ভারতীয়দের যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। এছাড়াও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে ভারতকে একটি কেরানী তৈরির দেশ হিসেবে পরিণত করেছিল। মূলত এসব ঘটনাই ব্রিটিশদের প্রতি ভারতীয়দের মনে ক্ষোভের সঞ্চয় করে।

▪ সিপাহী বিদ্রোহের রাজনৈতিক কারণঃ

সিপাহী বিদ্রোহে শুধুমাত্র ভারতীয় হিন্দু এবং মুসলিম সিপাহীরা যুক্ত ছিলেন না। সেই সময়ে কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও যুক্ত ছিলেন। তাদের সিপাহী বিদ্রোহে যুক্ত হওয়ার পেছনে কিছু নির্দিষ্ট কারণ ছিল। যেমন-

১) চরম সাম্রাজ্যবাদী লর্ড ডালহৌসি স্বত্ববিলোপ নীতি প্রবর্তন করে ভারতীয় দেশীয় রাজ্যগুলিকে দখল করার চেষ্টা করা ; 

২) মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাদশাহের বাদশাহ উপাধি কেড়ে নেওয়া, ভাতা বন্ধ করে দেওয়া সহ অন্যান্য অবজ্ঞা,

৩) ঝাসি রাজ্য দখল করার চেষ্টা করা ;অযোধ্যা রাজ্য জটিল সরাসরি দখল করে নেওয়া, নানা সাহেবের ভাতা বন্ধ বন্ধ করাও সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম রাজনৈতিক কারণ।

▪ সিপাহী বিদ্রোহের ধর্মীয় কারণঃ 

সিপাহী বিদ্রোহের পেছনে বেশ কিছু ধর্মীয় কারণ যুক্ত ছিল। যেমন-

১) ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসনের শুরু হওয়ার পরে খ্রিস্টান মিশরীরা এদেশে ব্যাপক পরিমাণে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার এবং প্রসার করতে থাকে। অন্যদিকে তারাই আবার হিন্দু এবং মুসলিম ধর্মের অপপ্রচার করতে থাকে। আর এতে কোম্পানি শাসনের ব্যাপক মদদ ছিল। 

২) অন্যদিকে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে সতীদাহ প্রথা রদ এবং ১৮৫৬ সালের বিধবা বিবাহ পাস করা একদিকে ভালো হলেও এতে কিন্তু ভারতের ধর্মীয় গোড়া হিন্দুরা ব্রিটিশ শাসনের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়।

▪ সিপাহী বিদ্রোহের অর্থনৈতিক কারণঃ 

১) ভারতের অভ্যন্তরে এবং ভারতের বাইরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার ভারতীয় বাণিজ্য ব্যাপক হারে ধ্বংস করে। 

২) অন্যদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রবর্তিত এক শালা, পাঁচ শালা, দশশালা,চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং অন্যদিকে রাউতওয়ারী, মহলওয়ারি বন্দোবস্তের মতো ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার কবলে পড়ে ভারতীয় কৃষকরা এবং জমিদার শ্রেণী অর্থনৈতিক দিক থেকে ভয়ংকর ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ফলে এই অর্থনৈতিক বিষয়টাও সিপাহী বিদ্রোহের পরোক্ষ কারণ ছিল।

* সিপাহী বিদ্রোহের নেতৃত্বঃ 

সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর উত্তর এবং মধ্য ভারতের ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রো ছড়িয়ে পড়ার পর বিভিন্ন অঞ্চলে যেমন বিহারের কুনওয়ার সিং, অযোধ্যার হযরত মহল, ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ, কানপুরের নানা সাহেব ও তাতিয়া তোপি প্রমুখ ব্যক্তি মহাবিদ্রোহের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন।

▪ দিল্লিতে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহঃ 

দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট। সিপাহী বিদ্রোহের বিদ্রোহীরা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে হিন্দু-মুসলিমের ঐক্যের প্রতি হিসেবে মহাবিদ্রোহে নেতৃত্ব দানের জন্য অনুরোধ জানান। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ বিদ্রোহীদের ডাকে সাড়া দেন। কিন্তু বিদ্রোহ সমাপ্ত হওয়ার পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮৫৮ সালে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে বর্মায় নির্বাসন দেয় এবং সেখানেই তার মৃত্যু ঘটে।

▪ কানপুরে সিপাহী বিদ্রোহের নেতৃত্ব নানা সাহেব ও তাতিয়া তোপীঃ

নানা সাহেব ছিলেন মারাঠা পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও এর দত্তপুত্র। দত্তকপুত্র হওয়ার কারণে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নানা সাহেবকে তাদের পারিবারিক রাজকীয় ভাতা থেকে বঞ্চিত করে। সেই সঙ্গে কানপুরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অত্যাচারও ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। সেই কারণে নানা সাহেব কানপুরে সিপাহী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন। কানপুরে সিপাহী বিদ্রোহের নানা সাহেবের সঙ্গে ছিলেন তারই বিশ্বস্ত সেনাপতি, তাতিয়া তোপি। 

▪ সিপাহী বিদ্রোহের নেতৃত্বে ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈঃ 

লর্ড ডালহৌসির প্রবর্তিত স্বতবিলোপ নীতির কারণেই ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ মূলত সিপাহী বিদ্রোহের যুক্ত হয়েছিলেন। গঙ্গাধর রাওয়ের সঙ্গে লক্ষ্মীবাঈয়ের বিবাহের অল্প সময়কালের মধ্যেই স্বামীর মৃত্যু ঘটে। ফলে তাদের কোনো পুত্র সন্তান ছিলনা। যার ফলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্বতবিলোপ নীতির জেরে ঝাঁসি রাজ্যটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে চায় মূলত এর প্রতিবাদ স্বরুপই ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ বীরত্বের সঙ্গে সিপাহী বিদ্রোহ ঝাপিয়ে পড়েছিলেন।

▪ লখনৌতে বেগম হযরত মহলের নেতৃত্বঃ

ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ ছাড়াও সিপাহী বিদ্রোহের সময়কালের ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন লখনৌয়ের নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের পত্নী বেগম হযরত মহল। মূলত নবাব কে অবৈধভাবে সিংহাসন থেকে সরিয়ে ফেলার প্রতিবাদস্বরুপই তিনি বিদ্রোহে যুক্ত হয়েছিলেন।

** মহাবিদ্রোহের ফলাফলঃ

মহাবিদ্রোহের সঠিক লক্ষ্য ও পরিকল্পনার অভাব শিক্ষিত এবং মধ্যবিত্তদের অসমর্থন এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যাপক দমনীতির কবলে পড়ে শেষ পর্যন্ত মহা বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল কিন্তু ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও মহাবিদ্রোহের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হয়েছিল। 

▪ মহাবিদ্রোহ শেষ হওয়ার পর অর্থাৎ ১৮৫৮ সালের ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নতুন ভারত শাসন আইন পাশ হয়। ১৮৫৮ সালের নতুন ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে ভারতের শাসন ক্ষমতা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে মহারানীর ভিক্টোরিয়া সরাসরি নিজের হাতে তুলে দেন। এবং এইভাবে মহারানীর প্রতিনিধি হিসেবে ভাইসরয়ের হাতে ভারতের শাসন ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়।

▪ এছাড়াও লর্ড ডালহৌসির আমলে যে স্বতবিলোপ নীতি প্রবর্তন করে দেশীয় রাজাদের পুত্র সন্তান দত্তক  অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল : সেই স্বতবিলোপ নীতিও বাতিল করে দেওয়া হয় মহাবিদ্রোহের পর।


Post a Comment

Previous Post Next Post