রাওলাট সত্যাগ্রহ ও জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস📑



complete-history-of-rowlatt-satyagraha-and-jalianwalabag-massacre-in-bengali


 ** রাওলাট আইন (Rowlatt Act)

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির দিকে ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি তীব্র ক্ষোভ দেখা যায়। এই সময়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন বৈপ্লবিক কার্যকলাপ যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া সেই সব বৈপ্লবিক কার্যকলাপ এবং গণআন্দোলন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়ার জন্য ; ইংল্যান্ডের বিচারপতি স্যার সিডনি রাওলাটের সভাপতিতে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে পাঁচজন সদস্য বিশিষ্ট রাওলাট কমিশন বা সিডনি কমিশন গঠন করা হয়। এরপর রাওলাট কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৮ই মার্চ ভারতের কেন্দ্রীয় আইন সভায় একটি দমনমূলক আইন পাস হয় যা রাওলাট আইন নামে পরিচিত


**রাওলাট আইনের বিভিন্ন দিকঃ 


ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভা যখনই দমনমূলক বিলটি উত্থাপিত হয়েছিল :তখনই ভারতীয়দের মধ্যে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। কারণ রাওলাট আইনটি সম্পূর্ণভাবে ভারতীয়দের দমন করার জন্যই তৈরি করা হয়েছিল। রাওলার আইনটি মূলত ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদ; গণ আন্দোলন ; বিপ্লবী কার্যকলাপ প্রভৃতিকে সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই প্রণয়ন করা হয়েছিল। এবং এই দিকটা এই আইনের বিভিন্ন ধারায় খুবই সহজে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন-

১) প্রথমতঃ  রাওলাট আইনে ব্রিটিশ সরকার বিরোধী সব ধরনের প্রচারকার্য দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়।

২)দ্বিতীয়তঃ এই আইনে বলা হয় ব্রিটিশ সরকার সন্দেহভাজন যেকোনো ব্যক্তিকে বিনা গ্রেফতারি পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারবে ; বিনা বিচারেই অনির্দিষ্টকালের জন্য তাকে আটক বা নির্বাসন করতে পারবে ; এবং আদালতে ব্যক্তির বিচারে যে রায় হবে; সেই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আবার আপিল করা যাবে না।

৩) তৃতীয়তঃ রাওলাট আইনে আবার ভারতীয় সংবাদপত্র গুলির স্বাধীনতাও কেড়ে নেয়। আইনে বলা হয় কোনো সংবাদপত্র স্বাধীনভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে না।

৪) এছাড়াও এই আইনে বলা হয় ; সরকার চাইলে যেকোনো ব্যক্তির বাড়ি বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি করতে পারবে।


** রাওলাট সত্যাগ্রহ (Rowlatt Satyagraha)

সম্পূর্ণরূপে ভারতীয়দের দমন করার উদ্দেশ্যে প্রণীত রাওলাট আইনটি প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সর্বত্র এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। দা হিন্দু দা নিউ ইন্ডিয়া অমৃতবাজার পত্রিকার সহ তৎকালীন সময় ভারতের বিভিন্ন সংবাদপত্রে তীব্র বিরোধিতা করা হয় সেইসঙ্গে ভারতীয় আইন পরিষদ থেকে ভারতীয় সদস্যরাও পদত্যাগ করেন। মহাত্মা গান্ধী একসময় পর্যন্ত ভারতের ব্রিটিশ শাসনকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলে মনে করতেন। কিন্তু রাওলাট আইন প্রবর্তনের পর তিনি এটা বুঝে যান যে ব্রিটিশ সরকারের শাসন আসলে শয়তানবাদের প্রবর্তন। সেই কারণে তিনি রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘস্থায়ী সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করার ডাক দেন এবং গান্ধীজীর নেতৃত্বে সাড়া দিয়ে ভারতীয়রা সেই সে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে শামিল হয়। গান্ধীজির নেতৃত্বে রাওলাট সত্যাগ্রহ বলতে গেলে মার্চ থেকে শুরু করে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ঠিকভাবে চলেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে রাওলাট সত্যাগ্রহে প্রচন্ড পরিমাণে হিংসার প্রবেশ ঘটলে গান্ধীজি মর্মাহত হন এবং ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে জুলাই মাসে তিনি রাওলাট সত্যাগ্রহ প্রত্যাহার করে নেন।


** জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডঃ


▪ ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই মার্চ কুখ্যাত রাওলার আইনটি পাস হলে এই আইনের বিরুদ্ধে সারাদেশেই তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়। রাওলাট আইন প্রবর্তন সহ ব্রিটিশ সরকারের কিছু অন্যান্য নীতির কারণে,পাঞ্জাবে ব্যাপক প্রতিবাদী আন্দোলন শুরু হয় এবং তৎকালীন সময়ে পাঞ্জাবের পরিস্থিতি খুবই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। 

▪ পাঞ্জাবের মুখ্য প্রশাসক লেফটেন্যান্ট গভর্নর মাইকেল ও ডায়রের অত্যাচারী শাসন ; দমনমূলক রাওলাট আইন ; পিপলস কমিটি নামক একটি গণসংগঠনের নেতা ডঃ সাইফুদ্দিন কিচলু এবং ডঃ সত্যপাল সিনহার গ্রেপ্তার প্রভৃতি ঘটনার প্রতিবাদ স্বরূপ ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ১৩ই এপ্রিল পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরের জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঠে এক বিরাট জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রায় পাঞ্জাবের ১০ হাজারের বেশি নিরস্র সাধারণ মানুষ উপস্থিত হন। সমাবেশটি এমন স্থানে অনুষ্ঠিত হয় যেখানে প্রবেশের জন্য একটি এবং বেরোনোর জন্য চারটি শুরু গলিপথ রাখা হয়েছিল। এবং তার চারিদিকে উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। সভা চলাকালীন হঠাৎ সেখানে সামরিক শাসনকর্তা জেনারেল মাইকেল ও ডায়ার তার বিরাট সৈন্য বাহিনী নিয়ে উপস্থিত হন এবং তিনি সমাবেশে নিরস্র জনতাকে কোনো রকম কোনো সতর্কবার্তা না দিয়েই তারা সেনাবাহিনীকে তাদের ওপর নির্মিতারে গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়। জালিয়ানওয়ালাবাগের সেই মাঠে প্রায় ৫০টি রাইফেল থেকে অন্ততপক্ষে ১০ মিনিট ধরে ১৬০০ রাউন্ড গুলি চলে। মাইকেল ও ডায়ারের এরকম নির্মম নির্দেশে সেখানে প্রায় ১ হাজার শিশু, নারী, বৃদ্ধ নিহত হন। ভারতীয়দের উপর চলা, নির্মম ব্রিটিশ শাসনের এই ঘটনাই জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড নামে পরিচিত।

**জালিয়ানওয়ালাবাগের এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ স্বরুপ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাইট উপাধি এবং মহাত্মা গান্ধী কাইজার-ই হিন্দ উপাধি ত্যাগ করেন।

Post a Comment

Previous Post Next Post