১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত লর্ড কার্জন ভারতের ভাইসরয় ছিলেন। এই সময়কালে লর্ড কার্জনের যে কর্মকাণ্ড ছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলল ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ভাইসরয লর্ড কার্জন হঠাৎ করেই ঘোষণা করেন যে এখন থেকে বাংলাকে দুটি ভাগে ভাগ করা হবে। যথা পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিমবাংলা। লর্ড কার্জনের এই ঐতিহাসিক ঘোষণার পরে সমগ্র বাংলা উক্তল হয়ে পড়েছিল এবং ভারতীয়রা এর ব্যাপক বিরোধিতা করতে শুরু করেছিল। বলতে গেলে এখান থেকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক নতুন অধ্যায়ের শুরু হয়েছিল।
▪ বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা কী?
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই অক্টোবর লর্ড কার্জন ঘোষণা করেন যে প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে এখন থেকে সমগ্র বাংলাকে দুটি ভাগে ভাগ করা হবে। একটি হবে পশ্চিমবাংলা, যেটা মূলত বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ,বিহার এবং উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত হবে। যার রাজধানী হবে কলকাতা। অন্যদিকে বাংলার আরেকটি ভাগ হবে পূর্ব বাংলা যেটা মূলত বর্তমান বাংলাদেশ এবং আসাম নিয়ে গঠিত হবে এবং তার রাজধানী হবে ঢাকা। লর্ড কার্জন এই বঙ্গভঙ্গের ঘোষণার পেছনে কারণ দেখিয়েছিলেন যে এত বিরাট সংখ্যক জনসংখ্যার প্রদেশকে প্রশাসনিক দিক থেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। যদি বাংলাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয় তাহলে একদিকে যেমন সরকারি প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে সুবিধা হবে,,একইভবে উভয় প্রদেশের জনগণের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে সহজে পৌঁছবে এবং তাদের অর্থনৈতিক বিভিন্ন দারি দাওয়া সরকার পূর্ণ করতে পারবে।
▪ বঙ্গভঙ্গের কারণসমূহঃ
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন যে বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা করেছিলেন ;সেই বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার পেছনে দুই ধরনের কারণ ছিল। একটি ছিল পরোক্ষ কারণ এবং অপরটি ছিল প্রত্যক্ষ কারণ।
▪ বঙ্গভঙ্গের পরোক্ষ কারণঃ বাংলাকে দুই ভাগে ভাগ করার কারণ হিসেবে লর্ড কার্জন বঙ্গবাসীকে যেটা বুঝিয়েছিলেন ; সেটা হলো মূলত বঙ্গভঙ্গের পরোক্ষ কারণ। বাংলা কে ভাগ করার কারন হিসেবে লর্ড কার্জন বলেন যে এতো বিরাট সংখ্যক জনগণের প্রদেশের সঠিক প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। সেই কারণে বাংলাকে দুই ভাগে ভাগ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
▪ বঙ্গভঙ্গের প্রত্যক্ষ কারণঃ বাংলা কে ভাগ করার পেছনে লর্ড কার্জন উপরিক্ত বিষয়টা বঙ্গবাসীকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও এর পেছনে নির্দিষ্ট কিছু রাজনৈতিক কারণ ছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফলে উনিশ শতকের মধ্যভাগে বাংলাত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ এবং প্রসার ঘটে। তারা রাজনৈতিক দিক থেকে সচেতন হতে শুরু করে। লর্ড কার্জন বাংলাকে ভাগ করে দিয়ে মূলত হিন্দু এবং মুসলিমদের আলাদা করা ; হিন্দু মুসলিমদের ঐক্য ভঙ্গ করা এবং বাংলায় জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশের ফলে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলো গড়ে উঠতো ; সেগুলো সেখানেই থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
▪ বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার প্রতিক্রিয়াঃ
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ১৬ ই অক্টোবর লর্ড কার্জন যখন বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা করেন তারপরেই সারা ভারতে বিশেষ করে বাংলায় এর তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
• সমগ্র বঙ্গ বঙ্গবাসী এই ঘোষণার তীব্র বিরোধিতা করতে শুরু করেন এখান থেকেই মূলত বিদেশি পণ্য বয়কট এবং স্বদেশী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।
• সমগ্র বাংলায় সমস্ত রকমের বিদেশী পণ্য বয়কট বা বর্জন করে স্বদেশী পণ্যের ব্যবহার শুরু হয়।
• ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কংগ্রেসের হাল চরমপন্থী নেতাদের হাতে থাকলেও বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার পরেই কংগ্রেসে বাল গঙ্গাধর তিলক বিপিনচন্দ্র পাল নানা লাজপত রায়ের মতো চরমপন্থী নেতাদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়।
• এই সময় পুরুষদের পাশাপাশি বাংলার নারীরাও বিদেশী চুরি বর্জন; বিদেশী পরিত্যাগ করা এবং সেই রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ডাকে সাড়া দিয়ে অরন্ধন দিবসও পালন করেন।
• বঙ্গভঙ্গের সময়ে সরলা দেবী চৌধুরানী আবার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন লক্ষ্মীর ভান্ডার।
• বঙ্গভঙ্গের ঘোষণায় সারা বাংলায় এতো তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ায় ১৯শে জুলাই ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা রদ করা হয়।
• বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা রদ হওয়ায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাখি বন্ধন উৎসব পালন করেন।
▪ বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার ফলাফলঃ
ভারতীয়দের ব্যাপক বিরোধিতায় শেষ পর্যন্ত লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা কার্যকর হয়নি। বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা কার্যকর না হলেও এর কিছু ফলাফল ছিল। যেমন-
১) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময়কালে বিদেশি পণ্য বয়কট এবং স্বদেশী পণ্যের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়।
২) বঙ্গভঙ্গ ঘোষণের আগে পর্যন্ত যে যে জাতীয়তাবাদী ভাবনা শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত শিক্ষিতদের মধ্যে সীমিত ছিল, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
৩) এছাড়াও বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার তীব্র বিরোধিতা চাপায় পড়ে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে,ভারতের রাজধানী ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা থেকে সরিয়ে নিয়ে দিল্লিতে স্থানান্তর করে।
Post a Comment