জেরেমি বেন্থামের উপযোগিতা বাদের অর্থ, বৈশিষ্ট্য এবং সমালোচনা

jeremy-bentham-utilitarianism-meaning-characteristics-criticism-in-bengali

Jeremy Bentham theory of Utilitarianism In Bengali : Meaning, Characteristics And Criticism. 

পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার অংশ হিসাবে আজ আমরা জেরেমি বেন্থামের উপযোগিতাবাদ বা হিতবাদ আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তাধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই তত্ত্ব মূলত "সর্বোচ্চ সুখের নীতি" (Greatest Happiness Principle)-এর উপর ভিত্তি করে গঠিত, যেখানে নৈতিকতার মাপকাঠি হিসেবে ব্যক্তিগত ও সামগ্রিক কল্যাণকে বিবেচনা করা হয়। এই প্রতিবেদনে আমরা জেরেমি বেন্থামের হিতবাদের সংজ্ঞা, এর মূল বৈশিষ্ট্য এবং প্রধান সমালোচনা নিয়ে আলোচনা করেছি। আশাকরি এই নোটটি ছাত্রছাত্রীদের কাজে লাগবে।

 ▪ উপযোগিতাবাদের অর্থঃ

হিতবাদ হল একটি দার্শনিক মতবাদ। হিতবাদ বা উপযোগী বাদ মূলত মানুষের সুখ নিয়ে আলোচনা করে। 'সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক সুখ লাভ' কী করে হবে সেটাই হিতবাদী দর্শনের মূল আলোচ্য বিষয়।


জেরেমি বেন্থামের উপযোগিতা বাদ ;


বিখ্যাত ইংরেজ রাষ্ট্র দার্শনিক জেরেমি বেন্থামের উপযোগিতাবাদ বা হিতবাদী দর্শন গড়ে উঠেছে উপযোগিতার নীতিকে কেন্দ্র করেই। জেরেমি বেন্থাম তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ 'An Introduction To The Principles Of Morals And Legislation' গ্রন্থে তাঁর হিতবাদী দর্শন বা উপযোগিতা ব্যাখ্যা করেছেন। জেরমি বেন্থাম তাঁর হিতবাদী দর্শন রচনার ক্ষেত্রে স্পিনোজা এবং হিউমের উপযোগিতার প্রয়োজনীয় তথ্য,  প্রিস্টলির দেওয়া আনন্দ এবং বেদনার ধারণা এবং হাচেসনের 'বহুজনের সর্বাধিক হিতসাধনের আদর্শ' দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এবং হিতবাদী দর্শনে তিনি নিজে যুক্ত করেছিলেন গাণিতিক হিসাব।


▪ বেন্থামের উপযোগীবাদ বা হিতবাদের অর্থ ;


জেরেমি বেন্থাম উপযোগিতাকে বস্তুর একটি ধর্ম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বেন্থামের মতে যদি কোনো বস্তুর দ্বারা মানুষের সুখ বা আনন্দ নিশ্চিত হয় তখনই সেই বস্তুর উপযোগিতা আছে বলে ধরা হবে। আর অপরদিকে যে বস্তু মানুষের দুঃখ বা কষ্টকে ডেকে আনে সেই বস্তু উপযোগিতাহীন বলে গণ্য করা হবে। বেন্থামের মতে আমাদের সেই সব বিষয়-ই গ্রহণ করা উচিত যেগুলি আমাদের সুখবৃদ্ধির সহায়ক হবে এবং সেই সকল বিষয় আমাদের বর্জন করা উচিত যেগুলো আমাদের দুঃখ বা কষ্টকে ডেকে আনে।।


জেরিমি বেন্থাম তার বিখ্যাত 'অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু দ্যা প্রিন্সিপ্যালস অফ মোরালস অ্যান্ড লেগিজলেশন' গ্রন্থে বলেছেন যে প্রকৃতি মানুষকে দুটি সার্বভৌম নিয়ত্রক / নিয়ন্তার অধীনে বেঁধে রেখেছে। একটি হচ্ছে মানুষের সুখ এবং অপরটি হলো দুঃখ। এই দুটি জিনিসই মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। এরাই ঠিক করে দেয় আমাদের কী করা উচিত বা আমরা কী করবো। মানুষ অধিক সংখ্যক সুখ বা আনন্দ ভোগ করতে চায় এবং নিজের দুঃখ থেকে পরিত্রান পাবার চেষ্টা করে এবং এই প্রবণতার মৃত্যুতেই মানুষের যাবতীয় চিন্তা আচরণ এবং কর্ম নিয়ন্ত্রিত বা নির্ধারিত হয়। 


 ▪ বেন্থামের উপযোগিতা বাদের বৈশিষ্ট্য


▪ ভোগসুখবাদীঃ জেরেমি বেন্থামের উপযোগী বা হিতবাদী তত্ত্ব হলো মূলত ভোগসুখবাদী। বেন্থাম তার এই তত্ত্বে কোনো উচ্চমার্গের নৈতিক, আধ্যাত্মিক বা অতীন্দ্রিয় সুখ লাভের কথা বলেননি। তিনি যে সুখ লাভের কথা বলেছেন তা হলো এ পার্থিব জগতের সুখ মাত্র। তিনি এই সুখকে মানুষের বস্তুমুখী স্বার্থ এবং সুবিধার সঙ্গে অভিন্ন করে দেখেছেন। বেন্থাম বলেছেন সুখ হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিগত অনুভূতি। অপরের সুখে মানুষ সুখী নয়, নিজের সুখেই সে তৃপ্ত। সুখ হলো তৃপ্তি এবং দুঃখ হলো কষ্ট বা যন্ত্রণা। 


সুখের পরিমাণগত দিকের অধিক প্রাধান্যঃ  বেন্থামের মতে এই পার্থিব জগতের সুখ লাভ করাই হলো মানুষের মূল লক্ষ্য এবং পার্থিব জগতে কী করে অধিক পরিমাণ সুখ লাভ করা যায় সেটাই মানুষের বিচার্য বিষয় হওয়া উচিত। কোনো এক কাজের মাধ্যমে অন্য কোনো কাজের থেকে বেশি পরিমাণ সুখ লাভ করা যায় কিনা সেটাই আসল কথা। বেন্থাম বলেছেন যদি পুশপিন খোলার আনন্দ এবং কবিতা পাঠের আনন্দের পরিমাণ এক থাকে ; তাহলে উভয়ের সুখ বা আনন্দের মধ্যে কোনো গুণগত পার্থক্য থাকতে পারে না। তাই বলা যায় বেন্থামের উপযোগিতার নীতিতে তিনি সুখের গুণগত দিকটির বদলে পরিমাণগত দিকটিকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন।


সুখ ও দুঃখের পরিমাপের ক্ষেত্রে সুখকলনঃ জেরিমি বেন্থাম বলেছিলেন জগতের অন্যান্য বিষয়ের মতো আমরা সুখ-দুঃখকেও পরিমাপ করতে পারি। বেন্থাম সুখ-দুঃখের পরিমাপের ক্ষেত্রে সুখকলন তত্ত্বের কথা বলেছেন। বেন্থাম বলেছিলেন গাণিতিক নিয়মে আমরা সুখ ও দুঃখের পরিমাণ, পরিণামকে আমরা পরিমাপ ও তুলনা করতে পারি। সুখ-দুঃখকে পরিমাপের ক্ষেত্রে আমাদের কয়টি বিষয় দেখতে হয়। যেমন কোন সুখের তীব্রতা,তার নিশ্চয়তা কতখানি, তার স্থায়িত্ব কতটা, সেই দুঃখ আমাদের হাতের কাছে না দূরে রয়েছে, সেই সুখ দুঃখ থেকে কতটা মুক্ত, কতটা উর্বর এই বিষয়গুলো আমাদের দেখতে হবে। আবার সুকলন তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা সুখ ও দুঃখের পরিমাণের মধ্যে তুলনা করে দেখতে পারি কোনটার পরিমাণ বেশি হবে ও কোনটার পরিমাণ কম। যদি সুখের পরিমাণ বেশি হয় তাহলে মানুষের কাজ ও আচরণ হবে ভালো এবং দুঃখের পরিমাণ বেশি হলে তা হবে মন্দ।


▪ সমাজের হিতসাধনঃ অন্যান্য হিতবাদী দার্শনিকের মতো জেরেমি বেন্থামও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের সমর্থক। সেই কারণে বেন্থামও ব্যক্তির কল্যাণকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। হিতবাদীরা বলেন ব্যক্তির অংশগ্রহণ ছাড়া সমাজের পৃথক অস্তিত্ব থাকতে পারে না। সমাজ হল ব্যক্তির সমষ্টি মাত্র। তাই ব্যক্তিস্বার্থ এবং সামাজিক স্বার্থের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকতে পারে না। আর প্রত্যেক ব্যক্তির যেমন লক্ষ্য হওয়া উচিত সর্বোচ্চ পরিমাণ সুখ লাভ করা ; তাই ঠিক একইভাবে; সর্বাধিক সংখ্যক ব্যক্তির সর্বোচ্চ পরিমাণ হিত সাধন কী করে করা যায় সেটাই হওয়া উচিত সমাজেরও অন্তিম লক্ষ্য।


▪ ব্যক্তি স্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থ সমন্বয়ঃ জেরেমি বেন্থাম বুঝতে পেরেছিলেন ব্যক্তি স্বার্থের সঙ্গে সামাজিক স্বার্থের বিরোধ দেখা দিতে পারে। সেজন্যই তিনি উভয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধনের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বেন্থাম ভালো করেই জানতেন যে বেশিরভাগ মানুষই আত্মসম্মানের সুখে ধাবিত হবে। এবং তার ফলে ব্যক্তিগত স্বার্থের সঙ্গে সামাজিক স্বার্থের বিরোধ ঘটার সম্ভাবনা থাকবে। তাই বেন্থামের মতে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক স্বার্থের মধ্যে সমন্বয়ের ঘটনার জন্য এসব প্রয়োজন উপযুক্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থার এবং সেই সঙ্গে প্রয়োজন সমাজ এবং আইনি সংস্কারের।।


▪ বেন্থামের উপযোগিতা বাদের সমালোচনা ; 


দুঃখ কষ্ট ছাড়া মহৎ কাজ সম্ভব নয়ঃ   বেন্থাম বলেছেন মানুষ সব সময় দুঃখকে এড়িয়ে চলবে। কিন্তু মানুষ সবসময়ই যন্ত্রণাকে এড়িয়ে থাকতে চায় কথাটা সর্বাংশে সত্য নয়। অনেক সময় মানুষ আদর্শ বা নীতির জন্য লড়াই করে এবং তা করতে গিয়ে সে অবর্ণনীয় দুঃখ-যন্ত্রণা সহ্য করে থাকে। জাতীয় মুক্তি আন্দোলন অথবা বিপ্লবের জন্য যারা লড়াই করে তারা আনন্দ হয়তো পায় কিন্তু দুঃখ কম পায় না। দুঃখকে এড়িয়ে যেতে চাইলে পথিবীতে কোনো মহৎ কাজ আজ পর্যন্ত সম্পাদিত হত না। 


ব্যক্তি ও সামাজিক স্বার্থের মধ্যে সমন্বয়সাধনে ব্যর্থ ; বেন্থাম বলেছেন জীবনের সর্বাধিক পরিমাণ সুখ লাভ করাই হবে মানুষের চরম বা মূল্য। এবার নিজের সুখের পাশাপাশি অপরের সুখ কামনা করা এবং অপরের সুখে সুখী হলে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক স্বার্থের মধ্যে কোনো বিরোধ থাকে না। কিন্তু আত্মসুখী মানুষ অপরের সুখ চাইবে বা অপরের সুখে সুখী হতে চাইবে- এই কথা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। বেন্থাম মানুষের যে আচরণের কথা বলেছেন তা মানুষের নৈতিকতা নয় তা এক ধরনের সুবিধাবাদ। এবং এর ফলেই ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং সামাজিক স্বার্থের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা বাস্তবে সম্ভব হয়নি।


সুখকলন তত্ত্বের প্রয়োগ সম্ভব নয়ঃ বেন্থাম বলেছিলে সুখকলন তত্ত্বের প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা সুখের পরিমাপ করতে পারি। কিন্তু বাস্তবে সুখ,আনন্দ, দুঃখ হচ্ছে আমাদের মানসিক অনূভুতির বিষয়। আর মানসিক অনুভূতির বিষয় এমন যেকোনো জিনিসের সঠিক পরিমাপ সম্ভব নয়। দ্বিতীয়তঃ পরিমাপ করা গেলেও সকল ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়, সেই জ্ঞান ও সময় নিয়ে সঠিকভাবে নিজের সর্বোচ্চ পরিমাণ সুখের পরিমাণ নির্ণয় করা।


▪ অযৌক্তিকঃ উপযোগিতা বাদে বেন্থাম বলেছেন সর্বাধিক পরিমাণ সুখ লাভ করাই হলো মানুষের মূল এবং চরম লক্ষ্য। এবার সেই চরম লক্ষ্য অর্জনে তিনি নৈতিকতাকে গুরুত্ব দেননি। এবার মানুষ তার সর্বোচ্চ পরিমাণ সুখ লাভের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি যদি কাউকে হত্যা করে অর্থ উপার্জন করে বা অপরের ক্ষতি করে নিজে সুখ লাভ করে তাহলে সেটা কখনোই নৈতিকতার দিক থেকে গ্রহণযোগ্য হবে না আর এরূপ কিছু কখনো কাম্যও নয়। তাই বলা যায় কিছু ক্ষেত্রে এই নীতি অযৌক্তিক।



Post a Comment

Previous Post Next Post