সহজ ভাবে বুঝে নাও প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র তত্ত্ব

ideal-state-theory-of-plato-in-bengali

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রী হিসেবে আমরা যখনই
পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তা বা Western Political Thought পড়তে যাবো তখনই আমাদের প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র তত্ত্ব পড়তে হবে।। এবার অনেক ছাত্রছাত্রী আছে যাদের কাছে প্লেটোর আদর্শ তত্ত্ব বিষয়টা অনেকটাই জটিল মনে হয়। সেই কারণে আমরা আজকে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র তত্ত্বের" প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্র বলতে কী বুঝিয়েছেন, আদর্শ রাষ্ট্রের কী কী বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং সেই সঙ্গে প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের সমালোচনা (Plato's Ideal State Theory- Meaning, Characteristics And Criticism) বিস্তারিতভাবে আজকের এই ব্লগ পোস্টে আলোচনা করেছি।


Plato's Ideal State Theory || প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র তত্ত্ব

গ্রীক দার্শনিক প্লেটো তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'দ্য রিপাবলিক'এ একটি আদর্শ রাষ্ট্রের কথা বর্ণনা করেছেন। সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং সকলকে একটি ভালো জীবন উপহার দেওয়ায় ছিল তাঁর আদর্শ রাষ্ট্র দর্শনের মূল উদ্দেশ্য। বলা বাহুল্য কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা নয় বরং সম্পূর্ণ নিজের কল্পনার ভিত্তিতেই তিনি তার রাষ্ট্রদর্শনকে বর্ণনা করেছেন তার দ্য রিপাবলিক গ্রন্থে। 


রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং প্রয়োজনীতা : 


প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্র উপস্থাপনের শুরুতেই ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে সাদৃশ্য দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন ‘The state is Magnified Term Of Individual.’. তিনি বলেন মানব প্রকৃতিতে এমন কিছু রয়েছে, যা রাষ্ট্রের উপযােগী, আবার রাষ্ট্রে এমন কিছু রয়েছে, যা সমাজের উপযােগী।

▪ প্লেটো বলেছিলেন অন্যান্য প্রাণীদের থেকে মানুষের জীবন এজন্যই আলাদা যে, অন্যান্য প্রাণী শুধুমাত্র বেঁচে থাকতে চায় কিন্তু মানুষ বেঁচে থাকার পাশাপাশি একটি ভালো জীবন উপভোগ করতে চায়। কিন্তু মানুষের জীবন তখনই সুন্দর হয়ে ওঠে যখন তার বিভিন্ন চাহিদা বা প্রয়োজন গুলো পূরণ হয়। কিন্তু এককভাবে সেই সমস্ত চাহিদা বা প্রয়োজন পূরণ সম্ভব নয়। মানুষের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমেই সে সমস্ত প্রয়োজন পূরণ হতে পারে। এবং সেই সমস্ত প্রয়োজন গুলো মেটানোর জন্যই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রয়েছে। তাই বলা যায় মানুষ নিজস্ব তাঁগিদেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি করেছিল।


আদর্শ রাষ্ট্রের গঠন ;;


প্লেটোর বহু পূর্বে গ্রিক দার্শনিক পিথাগোরাস বলেছিলেন প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে 

▪ Reason (যুক্তি, তর্ক, কারণ)

▪ Courage (সাহস)

▪ Appetite (ইচ্ছা, চাহিদা বা ক্ষুধা) এই বৈশিষ্ট্য গুলি থাকে। পিথাগোরাসের দ্বারা প্লেটো গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে পরবর্তীকালে তার আদর্শ রাষ্ট্র এবং ন্যায় তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছিলেন।

▪ প্লেটো বলেন যে প্রত্যেক ব্যক্তির আত্মার মধ্যে উপরিক্ত তিনটি গুণ বা বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যেকোনো একটি গুণ গভীরভাবে দেখা যাবে। এবার প্রত্যেক ব্যক্তিকেই নিজের মধ্যে থাকা সেই গুন বা বৈশিষ্ট্য কে চিনতে হবে এবং যার মধ্যে যেটা বেশি পরিমাণে রয়েছে তাকে সেই অনুযায়ী নিজের পেশা বা কর্মজীবন বা শ্রেণি বেছে নিতে হবে।

▪ যার মধ্যে অতিরক্ত যুক্তি,তর্ক বা কারণ রয়েছে সে হবে দার্শনিক শ্রেণীর অন্তর্গত এবং সে হবে রুলিং ক্লাস বা শাসক শ্রেণীর। 

▪ যার মধ্যে অতিরক্ত পরিমাণে সাহস রয়েছে সে হবে রাষ্ট্রের সৈনিক বা যোদ্ধা শ্রেণীর।

▪ অন্যদিকে যার মধ্যে অতিরিক্ত চাহিদা রয়েছে ইচ্ছা রয়েছে বা ক্ষুধা রয়েছে সে রাষ্ট্রের প্রয়োজন মেটানোর জন্য বিভিন্ন কাজ করবে অর্থাৎ সে হবে উৎপাদক শ্রেণী।

মূলত এইভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণের ভিত্তিতে যখন সকলেই নিজের নিজের নিজের শ্রেণী বা কর্মজীবন বেছে নেবে তখনই মূলত সমগ্র রাষ্ট্র তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে যাবে। এবং রাষ্ট্র এই তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি যখন সেখানে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে তখনই সেটা একটা আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠবে।


প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্র বলতে কী বুঝিয়েছেন? 


প্লেটো তার দ্য পাবলিক গ্রন্থে আদর্শ রাষ্ট্র বলতে এমন একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে বুঝিয়েছেন, যেখানে প্রত্যেকেই নিজেই নিজের নিজের আত্মার গুণ বা বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে নিজস্ব শ্রেণি বা কর্ম জীবন বেছে নেবেন এবং এইভাবে সমগ্র সমাজ তিনটি শ্রেণীতে ভাগ হয়ে যাবে। এভাবে সমাজ তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি যখন সেখানে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে তখনই সেটা হবে একটা আদর্শ রাষ্ট্র।



প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য || Characteristics Of Plato's Ideal State


প্লেটো তাঁর 'দ্য রিপাবলিক' গ্রন্থে যে আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা করেছেন তার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কথা বলতে পারি। যেমন- 


▪ প্রথমত : তিনটি শ্রেণীর উপস্থিতি ; প্লেটোর মতে যখন প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের আত্মার প্রভাবশালী গুণের উপর ভিত্তি করে নিজস্ব শ্রেণীর বেছে নেবেন তখন একটি আদর্শ রাষ্ট্রে মূলত, শাসক শ্রেণী,মিলিটারি বা যোদ্ধা এবং উৎপাদক এই তিনটি শ্রেণী থাকবে। 


▪ দ্বিতীয়ত : রাষ্ট্রের জনসংখ্যা ;  প্লেটো বলেছিলেন একটি আদর্শ রাষ্ট্রের জনসংখ্যা হবে ৫০৪০ জন। জনসংখ্যা যদি এরকম নির্দিষ্ট হয় তাহলে একদিকে সেটা যেমন প্রশাসনিক কার্যের ক্ষেত্রে সুবিধা জনক হবে ঠিক একই ভাবে এই জনসংখ্যায় রাষ্ট্রের সম্পত্তির পরিমাণ বাড়বেও না কমবেও না এবং সেই কারণে রাষ্ট্রের সম্পত্তি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।


▪ তৃতীয়ত ; কার্যকরী বিশেষীকরণ ; প্লেটো বলেন রাষ্ট্রের তিনটি শ্রেণী সব সময় নিজস্ব কাজকর্ম করবেন কেউ কখনোই অপরের ব্যাপারে বা কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। যখন তিনটি শ্রেণি সঠিকভাবে নিজের কাজ করবে তখন তাদের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা গড়ে উঠবে এবং এই ভাবেই রাষ্ট্র এগিয়ে যাবে।


▪ চতুর্থ ; দার্শনিক রাজা : প্লেটোর মতে, দার্শনিক রাজা যেহেতু জ্ঞানী হবেন, সেই কারণে রাজনীতি সম্পর্কে, দেশ শাসন সম্পর্কে তার জ্ঞান থাকবে। এবং তিনি সবসময়ই যুক্তি এবং তর্কের ভিত্তিতে কাজ করবেন। সেই কারণে দার্শনিক রাজাই হবেন আদর্শ রাষ্ট্রের শাসক। এছাড়াও প্লেটো বলেন যখন দার্শনিক রাজার দ্বারাই রাষ্ট্র শাসিত হবে তখনই একমাত্র ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। 


পঞ্চম : ন্যায়বিচার ; প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে ন্যায়বিচারকে রেখেছেন। তার মতে ন্যায় বিচার হলো আদর্শ রাষ্ট্রের চতুর্থ অঙ্গ। তিনি বলেছেন যেকোনো মূল্যে রাষ্ট্রে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে কারণ ন্যায় বিচার ছাড়া কখনো একটি আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। তিনি আদর্শ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক উভয় ন্যায় প্রকার বিচার প্রতিষ্ঠা করার কথাই বলেছেন।


ষষ্ঠত : স্ত্রী পুরুষ সমান অধিকার : প্লেটো নারীদের ঘরে আটকে রাখা তাদের স্বাধীনতা বা সমান মর্যাদা না দেওয়ার খুব বিরোধী ছিলেন। তার মধ্যে নারীদের ঘরের কোণে আটকে রাখা এবং দেশের অর্ধেক জনগণকে ভোটাধিকার না দেওয়া একই ব্যাপার। সেজন্য তিনি আদর্শ রাষ্ট্রে নারী পুরুষকে সমান চোখে দেখা বা সমান অধিকার দেওয়ার কথা বলেছেন।।


▪ এছাড়াও প্লেটো বলেছেন যে আদর্শ রাষ্ট্রে প্রয়োজনের বেশি সম্পত্তি কখনোই দার্শনিক রাজা বা সৈনিক শ্রেণীর হাতে থাকা চলবে না। যদি তা থাকে তাহলে তাদের মধ্যে চাহিদা বা ক্ষুধা জন্মাবে এবং এর ফলে তাদের ব্যক্তিত্বই পরিবর্তিত হয়ে যাবে।



প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র তত্ত্বের সমালোচনা || Criticism Of Plato's Ideal State


প্লেটো তাঁর দ্য পাবলিক গ্রন্থে সক্রেটিসের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, সম্পূর্ণ নিজস্ব কল্পনার ভিত্তিতে যে আদর্শ রাষ্ট্রের কথা তুলে ধরেছেন, সেটাকে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমালোচনা করা হয়েছে।


▪ প্রথমত ; বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব নয়  ; প্লেটো যে তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের কথা বলেছেন সেটা তিনি সম্পূর্ণ নিজস্ব কল্পনার ভিত্তিতে ব্যখা করেছেন। সেখানে তাঁর কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল না। সেই কারণেই বলা হয় তাঁর এই আদর্শ রাষ্ট্রের কখনোই বাস্তব অস্তিত্ব বা বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব নয়।


▪ দ্বিতীয়ত ; নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কাম্য নয় ; আদর্শ রাষ্ট্রে প্লেটো দার্শনিক রাজার হাতেই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু একজনের হাতেই ক্ষমতা কেন্দ্রীয়করণ বা নিরঙ্কুশ ক্ষমতা সর্বদা সকলের জন্য ভালো নাও হতে পারে। যেকোনো সময় তিনি স্বৈরশারীও হয়ে উঠতে পারেন।


▪ তৃতীয়ত ; গুণের বিকাশে সহায়ক নয় : পেটো সকলকে নিজের গুণ অনুযায়ী শ্রেণীর বেছে নিতে বলেছেন এবং একজনকে সারা জীবন একই ধরনের কাজ করতে বলেছেন। কিন্তু হতেই তো পারে একজন ব্যক্তির মধ্যে একাধিক গুন রয়েছে। তাহলে এই ধরনের শাসন ব্যবস্থায় কী করেই বা একজন ব্যক্তির সেই সমস্ত গুণের বিকাশ ঘটবে।


▪ চতুর্থ : সংবিধানকে উপেক্ষা : প্লেটো তাঁর দার্শনিক রাজা উপর এতটাই গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছেন যে তিনি একটি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যা অতি প্রয়োজনীয় অর্থাৎ আইন,সংবিধান এবং শক্তিশালী বিচার ব্যবস্থা সেই জিনিস গুলো তিনি একেবারেই উপেক্ষা করে গেছেন।।


▪ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী।- জ্ঞানের নিরঙ্কুশ ও অত্যাচারী শাসন স্বাধীনতা ও সমতার কোনো স্থান দেয় না। জ্ঞান এবং যুক্তির আধিপত্যের জন্য এই মূল্যবোধগুলি কার্যত বলি দেওয়া হয়। কারিগর এবং পরিশ্রমী, যারা সমাজের একটি বড় অংশ গঠন করে, তারা সম্পূর্ণরূপে অবহেলিত। তাই আদর্শ রাষ্ট্রের এই দৃষ্টিভঙ্গি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সম্পূর্ণ বিরোধী।


উপসংহারঃ 

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র যে একটি শুধুমাত্র স্বপ্নের শহর এবং এটি কেবল যে কল্পণাতে পাওয়া যায় তাতে সন্দেহ নেই। প্লেটো, যিনি সক্রেটিসের কাছ থেকে শিখেছিলেন যে সুন্দর জিনিস ছাড়া সৌন্দর্যের অস্তিত্ব থাকতে পারে না এবং তার মতো, তিনিও বিশ্বাস করতেন যে ধারণাটি বাস্তব, তিনি এই আদর্শ রাষ্ট্রটিকে শুধুমাত্র একটি 'ধারণা' হিসাবে কল্পনা করেছিলেন। এই ছিল তার 'ভালো' ধারণা। তিনি এর অস্থিরতা সম্পর্কে জানতেন এবং সে কারণেই তিনি স্টেটসম্যান এবং আইনের মতো পরবর্তী লেখাগুলিতে তার দ্বিতীয়-সেরা রাষ্ট্রের কথা বলেছেন।



Post a Comment

Previous Post Next Post