ভারতীয় গণপরিষদের ইতিহাস (গঠন ও কার্যাবলী)

composition-and-functions-of-indian-constituent-assembly-in-bengali



গণপরিষদ ও ভারতীয় সংবিধান || The Constituent Assembly and Constitution of India

ভারতীয় গণপরিষদ ভারতের বর্তমান সংবিধানের প্রণেতা। কোন গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধান সেই দেশের জনগণের দ্বারা রচিত হওয়াই ন্যায়সঙ্গত। তবে ভারতের মতো দেশে সকলের পক্ষে সংবিধান রচনার কাজে সোজাসুজি অংশগ্রহণ সম্ভব নয়। তাই দেশবাসীর প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংস্থা গঠন করে তার ওপর সংবিধান রচনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল। সেই সংস্থাকেই গণপরিষদ বলা হয়। পণ্ডিত নেহরু গণপরিষদের সংজ্ঞা দান করতে গিয়ে বলেছেন যে, "It means the masses of a country in action through their elected representatives." ভারতীয় গণপরিষদ স্থাপনের ইতিহাস ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসের ধারার সঙ্গে জড়িত। 1906 সালে ভারতের জন্যে গণপরিষদের দাবি উত্থাপিত হয়েছিল। 1922 সালে গান্ধীজী ভারতীয় গণপরিষদের দাবি ঘোষণা করেছিলেন। পরবর্তীকালে মানবেন্দ্র নাথ রায়ও একটি গণপরিষদ গঠনের ব্যাপারে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। 1934 সালে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ঘোষণা করেছিল যে, প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত গণপরিষদ সংবিধান রচনা করবে। 1940 সালে কংগ্রেসের রামগড় অধিবেশনে পূর্ণ স্বরাজ ও গণপরিষদ গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। 1946 সালে ব্রিটিশ সরকার যে ক্যাবিনেট মিশন প্রেরণ করেছিল তার মূল লক্ষ্য ছিল ভারতে গণপরিষদ গঠনের ব্যবস্থা করা।

গণপরিষদের গঠন || (Composition of the Constituent Assembly)

ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা অনুসারে চারটি মূল নীতির ভিত্তিতে ভারতে গণপরিষদ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই 4টি নীতি হল-
  1. ব্রিটিশ শাসিত প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যগুলো তাদের জনসংখ্যার অনুপাতে গণপরিষদে আসন পাবে। প্রত্যেক প্রদেশ থেকে প্রতি 10 লক্ষ জনগণের জন্যে একজন করে প্রতিনিধি গণপরিষদে প্রেরণ করা হবে। স্বাধীন ভারতের সংবিধানের দলিল রচনার জন্য গণপরিষদ গঠন করা হয়েছিল।
  2. গণপরিষদের সকল আসন সাধারণ জনগণ (অমুসলিম ও অশিখ), মুসলমান ও শিখ-এই তিন সম্প্রদায়ের মধ্যে আনুপাতিক হারে বিভক্ত হবে।
  3. প্রাদেশিক আইনসভার প্রতিটি সম্প্রদায়ের সদস্যগণ একক হস্তান্তবযোগ্য সমানুপাতিক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নিজ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে।
  4. দেশীয় রাজ্যগুলোকে 93 জন প্রতিনিধি প্রেরণের সুযোগ দেওয়া হবে। ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব অনুসারে গণপরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা 389 জন হবে বলে স্থির করা হয়। তার মধ্যে ব্রিটিশ-শাসিত প্রদেশগুলো থেকে 292 জন সদস্য আসবে। ঐ আসনগুলো আবার সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বিভক্ত করা হয়—মুসলমান 78, শিখ 4, সাধারণের জন্যে 210 টি।
ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব অনুসারে 1946 সালের জুলাই মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল। 292টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস 208, মুসলিম লীগ 73 ও অন্যান্য আসনগুলো কমিউনিস্ট, সোস্যালিস্ট, নির্দল প্রভৃতি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলো লাভ করেছিল। এইভাবে গণপরিষদ গঠনের পর গণ-পরিষদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল 1946 সালের ৭ ডিসেম্বর দিল্লিতে।

গণপরিষদের কার্যাবলী || (Functions of the Constituent Assembly)

1946 সালের ৭ ডিসেম্বর গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল। মুসলিম লীগের সদস্যরা ঐ অধিবেশনে অনুপস্থিত ছিলেন। তাঁরা পৃথক পাকিস্তান সৃষ্টির দাবিতে অনড় ছিলেন। গণপরিষদের প্রথম অস্থায়ী সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন গণপরিষদের সবচেয়ে বয়স্ক স্বচ্ছিদানন্দ সিংহ। তবে ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ গণপরিষদের স্থায়ী সভাপতি নির্বাচিত হন। 12 ডিসেম্বর সভার কার্যবিবরণী সম্পর্কিত কমিটি গঠিত হয়েছিল। গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন চলেছিল 23 ডিসেম্বর পর্যন্ত। গণ পরিষদ 14-15 আগস্টের (1947) মধ্যরাতে পূর্ণ সার্বভৌম সংস্থার মর্যাদা লাভ করে। ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ গণ-পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। শ্রী জওহরলাল নেহেরু একটি Objective Resolution পাশ করে কতকগুলো নীতি পেশ করেন:
  1. ভারতে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে।
  2. জনগণই সব ক্ষমতার উৎস—এই নীতি স্বীকার করা হবে।
  3. সব নাগরিকের জন্য ন্যায় বিচার, সাম্য ও স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করতে হবে।
  4. আদিবাসী ও অনুন্নত সম্প্রদায়ের কল্যাণের জন্য যথাযথ রক্ষাকবচের (safe-guards) ব্যবস্থা থাকবে।

1947 সালের 20 জানুয়ারি গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয়। ঐ সময় কতকগুলো কমিটি গঠিত হয়। ঐ অধিবেশনে হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়কে গণপরিষদের সহসভাপতি হিসাবে নির্বাচিত করা হয়।

1947 সালের 22 এপ্রিল গণপরিষদের তৃতীয় অধিবেশন শুরু হয়েছিল। সেই সময় দুটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটি গঠিত হয়- (1) কেন্দ্রীয় শাসনতন্ত্র সম্পর্কিত কমিটি, (2) প্রাদেশিক শাসনতন্ত্র সম্পর্কিত কমিটি।

1947 সালের 14 জুলাই গণপরিষদের চতুর্থ অধিবেশন শুরু হয়েছিল। ঐ অধিবেশনে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সংবিধানের মূল নীতি সম্পর্কে আলোচনা হয়। ঐ অধিবেশনেই মৌলিক অধিকার, সংখ্যালঘু কমিটি, উপজাতি সম্পর্কে পরামর্শদাতা কমিটির রিপোর্ট পেশ করা হয়েছিল।

1947 সালের 14 আগস্ট মধ্যরাত্রে গণপরিষদের চতুর্থ অধিবেশন বসে। ভারত সরকারের পক্ষে গণপরিষদ ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল।

▪ ভারত বিভাগের পর গণপরিষদের সদস্য ছিল 229 জন—কংগ্রেস 192 জন, মুসলিম লীগ 29 জন, আকালী 1 জন, অন্যান্য 7 জন। 1947 সালের 15 আগস্ট থেকে গণপরিষদ সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন পরিষদের মর্যাদা লাভ করেছিল।


গণপরিষদের খসড়া কমিটি এবং সংবিধান রচনা;-

  • গণপরিষদের পঞ্চম অধিবেশনে (15-29 আগস্ট) মাউন্ট ব্যাটেনকে স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করা হয়।
  • ঐ অধিবেশনে একটি খসড়া কমিটি গঠিত হয়। ঐ খসড়া কমিটির ওপর খসড়া সংবিধান রচনার ভার অর্পণ করা হয়।
  • খসড়া কমিটির সভাপতি হিসাবে ডা. বি. আর. আম্বেদকর মনোনীত হন।
  • 1948 সালের 21 ফেব্রুয়ারি খসড়া কমিটি গণপরিষদের কাছে খসড়া সংবিধান পেশ করে।
  • খসড়াটি জনগণের মধ্যে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়।
  • খসড়া সংবিধানের ওপর 7 হাজারের বেশি সংশোধনী প্রস্তাব এসেছিল।
  • তার মধ্যে 2437টি সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলে।
  • অবশেষে, 1949 সালের 26 নভেম্বর গণপরিষদে ভারতের সংবিধান গৃহীত হয়।
  • গণপরিষদের সর্বশেষ অধিবেশন বসেছিল 1950 সালের 24 জানুয়ারি। সেই অধিবেশনে ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদকে প্রথম রাষ্ট্রপতিরূপে নির্বাচিত করা হয়।
  • 1950 সালের 26 জানুয়ারি থেকে স্বাধীন ভারতের সংবিধান কার্যকর হয়।
  • ভারতের সংবিধান রচনা করতে গণপরিষদের প্রায় 3 বছর সময় লেগেছিল।
  • গণপরিষদের মোট 11টি অধিবেশন বসেছিল।
  • তথ্যসূত্র: ছাত্রছাত্রীদের জন্য আজকের এই নোটটি সংগ্রহ করা হয়েছে দি ওয়ার্ল্ড প্রেস প্রাইভেট লিমিটেড থেকে প্রকাশিত শক্তি মুখোপাধ্যায় এবং ইন্দ্রানী মুখোপাধ্যায়ের ভারতের সংবিধান ও শাসন ব্যবস্থা নামক গ্রন্থটি থেকে।




    Post a Comment

    Previous Post Next Post