Meaning, Causes And Characteristics Of Cold War (1946-1991) In Bengali :
▪ ঠান্ডা যুদ্ধের অর্থ || Meaning Of Cold War
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান,ইতালি এবং জার্মানি পরাজিত হলেও এবং মিত্রশক্তির দেশগুলি বিজয়ী হলেও ব্রিটেন এবং ফ্রান্স আর্থিক দিক থেকে চরম ক্ষতির শিকার হয় এবং অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই সময় সবার শেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করায় তার সেই ভাবেও কোনো আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই পৃথিবীর সর্বোচ্চ শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে উঠে আসে।। সেই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই দুটি দেশ-ই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ,শক্তি বা প্রভাব বৃদ্ধির কাজ করতে থাকে। ফলে সেই সময় থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দিতা,অবিশ্বাস,বিরোধ এবং উত্তেজনামূলক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে থাকে এবং দুটি দেশের মধ্যেই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কিন্তু সেই সময় দুটি দেশের করা প্রত্যক্ষ যুদ্ধ হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সেই যে যুদ্ধকালীন,উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি বজায় ছিল সেটাই হচ্ছে ঠান্ডা যুদ্ধ।
** What Is Cold War? || ঠান্ডা লড়াই বা ঠান্ডা যুদ্ধ কী?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ১৯৪৫ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, যুদ্ধের আবহাওয়া বা ছায়া যুদ্ধ চলতে থাকে সেটাকেই বলা হয় ঠান্ডা যুদ্ধ। 'যুদ্ধও নয় শান্তিও নয়' এমন এক অবস্থাই হলো ঠান্ডা যুদ্ধ। ঠান্ডা যুদ্ধ হলো মূলত অস্বস্তিকর শান্তির অবস্থা।
ঠান্ডা লড়াই প্রত্যক্ষ যুদ্ধ নয় তা হল যুদ্ধের উদ্বেগ এবং উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি। তাই কেউ কেউ ঠান্ডা যুদ্ধকে 'যুদ্ধহীন যুদ্ধ' বলে চিহ্নিত করেন।
** মার্কিন সাংবাদিক ওয়াল্টার লিপম্যান ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর 'The Cold War' গ্রন্থে সর্বপ্রথম ঠান্ডা লড়াই কথাটি ব্যবহার করেছিলেন।
ঠান্ডা লড়াইয়ের উৎপত্তির কারণসমূহ || Causes Of Cold War In Bengali
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে ঠান্ডা যুদ্ধ বা ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়েছিল ; তার পিছনে বিভিন্ন কারণ ছিল।
ঠান্ডা লড়াইয়ের উৎপত্তির কারণগুলিকে চিহ্নিত করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা বিশেষত মার্কিন বিশেষজ্ঞরা ভিন্ন ভিন্ন অভিমত প্রকাশ করেছেন। ঠান্ডা যুদ্ধের কারণ সম্পর্কিত সেসমস্ত অভিমতগুলিকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে।
১) প্রথমত সাবেকি গোড়া অভিমত ;
২) দ্বিতীয়ত সংশোধনবাদী অভিমত এবং
৩) তৃতীয়ত বিকল্প বা বাস্তববাদী অভিমত
▪ প্রথমত সাবেকি গোঁড়া অভিমত
ঠান্ডা লড়াইয়ের উৎপত্তির কারণ চিহ্নিত করতে গিয়ে মার্কিন সরকার এবং মার্কিন পন্ডিতরা যে অভিমত প্রদান করেছেন সেটা হচ্ছে সাবেকি গোঁড়া অভিমত। এই অভিমতের প্রবক্তাদের মতে ঠান্ডা যুদ্ধের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নই দায়ী।
তাদের মতে স্ট্যালিনের কিছু কার্যকলাপ যেমন-
১) সামগ্রিকভাবে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার প্রয়াস ;
২) ইয়াল্টা সম্মেলনের প্রতিশ্রুতি গুলি ভঙ্গ করা;
৩) সামরিক কার্যকলাপের মাধ্যমে ফ্রান্স এবং ইতালির ক্ষমতাশীন সরকার গুলোকে উৎখাত করার প্রচেষ্টা;
৪) মার্কিন বিরোধী কার্যকলাপ;
৫) এবং সমগ্র ইউরোপে সাম্যবাদের প্রভাব বা কর্তৃত্ব বৃদ্ধির উগ্র বাসনাই ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রকৃত কারণ।
▪ দ্বিতীয়ত সংশোধনবাদী অভিমত
সাবেকি গোঁড়া অভিমতটি অত্যন্ত পরিমাণে মার্কিন ঘেঁষা বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতিত্ব মূলক হওয়ায় বিরোধীরা এর সম্পূর্ণ বিপরীত অভিমত ব্যক্ত করেছেন। সংশোধনবাদী অভিমতের প্রবক্তাদের মতে ঠান্ডা লড়াইয়ের উৎপত্তি প্রধান কারণ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র সোভিয়েত ইউনিয়ন বিরোধী মনোভাব এবং কার্যকলাপ বা উভয় দেশের মধ্যে তীব্র মতাদর্শগত পার্থক্য। ঠান্ডা লড়াইয়ের পেছনে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশেষ কোনো দায় দায়িত্ব ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি বিশেষ পরিমাণে আতঙ্কগ্রস্ত হয়। কারণ তারা এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে ভবিষ্যতে পুঁজিবাদের বিকল্প হিসেবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সেই কারণে ১৯৪৫ সালের পর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা কমিউনিজমের প্রসার ও প্রভাব বৃদ্ধি রোধ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,ব্রিটেন এবং ফ্রান্স কিছু অযৌক্তিক এবং অকাম্য নীতি এবং কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। যেমন ট্রুম্যান নীতির ঘোষণা, মার্শাল পরিকল্পনা গ্রহণ, NATO গঠন ইত্যাদি। সেই অবস্থায় নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য কিছু কঠোর নীতি গ্রহণ করা ছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের সামনে কোনো বিকল্প পথ খোলা ছিল না।। ফলে বলা যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন বিরোধী কার্যকলাপ থেকেই ঠান্ডা লড়াইয়ের সূচনা হয়েছিল।
▪ তৃতীয়ত বিকল্প বা বাস্তববাদী অভিমত
ঠান্ডা লড়াইয়ের কারণ হিসেবে যে প্রথম এবং দ্বিতীয় অভিমত দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে কোনটিকেই সম্পূর্ণ সঠিক বলে তৃতীয় অবরোধের প্রবক্তারা মেনে নিতে পারেননি। সেই কারণে তারা ঠান্ডা লড়াইয়ের উৎপত্তি বিকল্প অভিমত ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। তাদের মতে-
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর-
১) সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-এই দুটি বৃহৎ শক্তির বিষয়গত অবস্থা ;
২) দুটি দেশের রাজনীতি এবং পররাষ্ট্রনীতির আপাতদৃষ্ট প্রকৃতি এবং ঐতিহাসিক ধরন;
৩) নিরাপত্তা বৃদ্ধি এবং শক্তি বৃদ্ধির জন্য পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পশ্চিম ইউরোপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আপন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার ফলে উভয়ের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা, পারস্পরিক অবিশ্বাস ভুল বোঝাবুঝি,সন্দেহ, বিদ্বেষ,অসন্তোষ ও বিরোধ বাড়তে থাকে। তাহলে এভাবেই সর্বপ্রথম ইউরোপের ঠান্ডা সূত্রপাত হয়েছিল।
উপসংহারঃ ঠান্ডা লড়াই উৎপত্তির কারণ হিসেবে যে তিনটি অভিমত আলোচনা করা হয়েছে সেই তিনটি অভিমতের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের পর এটাই ধরা হয়ে যে, ঠান্ডা লড়াই এর উৎপত্তির পেছনে যেসব কারণ রয়েছে সেগুলির মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্যই ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। এদিক থেকে বলা যায় সংশোধনবাদী অর্থাৎ দ্বিতীয়টি অভিমতটি গ্রহণযোগ্য।
▪ ঠান্ডা লড়াইয়ের বৈশিষ্ট্য (Characteristics / Features Of Cold War)
১৯৪৫ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘদিন ধরে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে ঠান্ডা লড়াই চলেছিল, সেই ঠান্ডা লড়াইয়ের একাধিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। তার মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো-
▪ রাজনৈতিক মহাদেশের লড়াইঃ আপাতদৃষ্টিতে দেখতে গেলে ঠান্ডা লড়াই ছিল মূলত দুই ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক মতাদর্শ অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক বা সাম্যবাদ এবং অপরদিকে তার বিরোধিতায় ছিল পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক মতাদর্শ। সাম্যবাদ এবং পুঁজিবারের এই পারস্পরিক বিরোধিতাকে কেন্দ্র করেই সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘদিন সেই ঠান্ডা লড়াই চলে।
• প্রত্যক্ষ যুদ্ধ না হওয়াঃ ঠান্ডা লড়াই চলে ছিল বিশ্বের দুই অতি বৃহৎ শক্তিশালী রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। ঠান্ডা লড়াই এই দুটি দেশের মধ্যে চললেও এই দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে কখনোই কোনো প্রত্যক্ষ যুদ্ধ হয়নি। অর্থাৎ ঠান্ডা লড়াই ছিল একপ্রকার 'যুদ্ধহীন যুদ্ধ'। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি বা আবহাওয়া তৈরি হলেও, এই দুটি দেশ কখনোই সরাসরি প্রত্যক্ষ যুদ্ধে যায়নি।
▪ দ্বি-মেরুকরণঃ ঠান্ডা যুদ্ধ চলাকালে সমগ্র বিশ্বের দেশ গুলি দুটি মেরুতে ভাগ হয়ে যায়। একদিকে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে থাকা সাম্যবাদী বা সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলি এবং অন্যদিকে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে থাকা পশ্চিম ইউরোপের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রজোট। যদিও ঠান্ডা যুদ্ধের শেষ দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে দ্বি-মেরুকরণ রাজনীতির পরিসমাপ্তি ঘটে এবং সমগ্র বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক প্রভাব, নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয়।
▪ সামরিক শক্তি বৃদ্ধিঃ ঠান্ডা যুদ্ধ চলাকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছিল। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে যেমন ন্যাটো গড়ে তোলে, এর ঠিক প্রতিবাদে সোভিয়েত ইউনিয়নও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে আবার Warsaw Pact গঠন করে।
▪ পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতাঃ সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই যুদ্ধ চলাকালীন নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি করার জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশ গুলির প্রতি আর্থিক এবং সাময়িক সাহায্য সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর জন্য ট্রুম্যান নীতি, মার্শাল পরিকল্পনার মতো নীতি গ্রহণ করে ঠিক একইভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নও সমাজতান্ত্রিক কমিউনিস্ট দেশগুলির জন্য কমেকন এবং কমিনফর্ম গঠন করেছিল।
▪ প্রক্সি যুদ্ধ বা ছায়াঃ সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ হয়নি ঠিকই কিন্তু তাদের মধ্যে ছায়া যুদ্ধ বা প্রক্সি ওয়ার চলেছিল। কোরিয়া যুদ্ধ এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে এই দুই মহাশক্তি পরোক্ষভাবে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। তবে হ্যাঁ ১৯৬২ সালের কিউবা সংকট এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করে যেখান থেকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়তো আর কয়েক হাত দূরে ছিল।
Post a Comment