🎯চার্বাক দর্শনের উপর সম্পূর্ণ নোট : অর্থ; ইতিহাস এবং পরীক্ষাভিত্তিক নোটস📕

Charvaka Philosophy Notes In Bengali : ভারতীয় দর্শনের দুটি শাখা রয়েছে। যথা আস্তিক দর্শন এবং নাস্তিক দর্শন। এবার নাস্তিক দার্শনিক সম্প্রদায়ের মধ্যে কঠোরতম নাস্তিক হলো চার্বাক দার্শনিক সম্প্রদায়। যারা একাদশ শ্রেণীতে প্রথমবারের জন্য চার্বাক দর্শন (Charbak Dorshon) পড়তে যাচ্ছ তাদের জন্যই আমাদের আজকের এই ব্লগ পোস্ট। চার্বাক দর্শন কী? এর ইতিহাস এবং চার্বাক দর্শন থেকে পরীক্ষায় যে সমস্ত প্রশ্ন সাধারণত হয়ে থাকে, সেই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর এই ব্লগপোস্টে পেয়ে যাবে।

---

চার্বাক দর্শন (CHARVAKA DARSHAN) 

সাধারণভাবে ভারতে যে সমস্ত দার্শনিক সম্প্রদায় বেদের প্রামাণ্যে বিশ্বাসী বা ঈশ্বরে বিশ্বাসী তাদের আস্তিক এবং অন্যদিকে যারা বেদের প্রমানে বিশ্বাসী নয় বা ঈশ্বরে বিশ্বাসী নয় তাদের বলা হয় নাস্তিক দার্শনিক সম্প্রদায়। ভারতে তিন ধরনের নাস্তিক দার্শনিক সম্প্রদায় রয়েছে। যথা বৌদ্ধ,জৈন এবং চার্বাক দর্শন। 

▪ নাস্তিক দার্শনিক সম্প্রদায়ের মধ্যে চার্বাক দার্শনিকরা হলেন কঠোরতম নাস্তিক। চার্বাকরা ঈশ্বর, পরলোক, আত্মায় বিশ্বাসী নয় এবং তারা মনে করেন বেদ আসলে ভন্ড পুরোহিতদের দ্বারা রচিত। 

▪ ভারতের চার্বাক দর্শন আসলে এক অতি প্রাচীন দর্শন। চার্বাকদের নিজস্ব কোনো প্রামান্য গ্রন্থ নেই ঠিকই কিন্তু রামায়ণ, মহাভারত, বেদ এবং প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে চার্বাক দর্শন সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায়। 

 ▪ চার্বাক শব্দটির অর্থঃ 

চার্বাক দর্শনের কোনো প্রামাণ্য গ্রন্থ বা নথি না থাকায় চার্বাক শব্দের প্রকৃত অর্থ কী সেই নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। চার্বাক শব্দের বিভিন্ন অর্থ পাওয়া যায়। যেমন অনেকে মনে করেন 'চার্বাক' নামে এক ঋষি এই দর্শনের প্রবর্তক বলে এর নাম হয়েছে চার্বাক। ▪ আবার এটাও শোনা যায়, চার্বাক শব্দটি আসলে (চারু+ বাক) শব্দের মিলিত একটি শব্দ যার অর্থ হলো মধুর কথা। চার্বাক দার্শনিকরা যেহেতু অর্থ এবং কাম বা ইন্দ্রিয় সুখকেই জীবনের একমাত্র কাম্য বস্তু বলে, 'যতদিন বাঁচবে সুখেই বাঁচবে,দরকার পড়লে ঋণ করেও ঘি খাবে' এই ধরনের মধুর কথা সাধারণ মানুষের কাছে প্রচার করতো, তাই বলে এর নাম হয়েছে চার্বাক। 

 ▪ আবার এটাও শোনা যায় যে চার্বাক শব্দটি আসলে 'চর্ব' ধাতু থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। চর্ব অর্থের চর্বন করা বা আহার, খাওয়া কে বোঝানো হয়। যেহেতু চার্বাক দার্শনিকগণ জাগতিক সুখ অর্থাৎ আহার পানীয় এগুলোকেই কাম্যবস্ত বলে মনে করে সেই কারণে এই দর্শনের নাম হয়েছে চার্বাক। 

 ▪ চার্বাক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতাঃ 

চার্বাক দার্শনিকদের বা চার্বাক দর্শন সম্প্রদায়ের নিজস্ব কোনো গ্রন্থ বা নথিপত্র না থাকায় চার্বাক দর্শনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা কে তা নিয়ে দর্শনিক মহলে মতভেদ রয়েছে। অনেকে বলেছেন যে, চার্বাক নামে এক ঋষি চার্বাক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর নাম অনুসারে চার্বাক দর্শনের নাম হয়েছে। আবার অনেকে বলেন যে চার্বাক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন দেবগুরু বৃহস্পতি। চারু শব্দের আর্থ হল বৃহস্পতি এবং বাক্‌ হল কথা । তাই চারু বাক্‌ অর্থাৎ বৃহস্পতির কথাই হল চার্বাক দর্শন । এই মতবাদটি প্রমাণের অভাবে বিতর্কিত রয়ে গিয়েছে। 

** চার্বাক দর্শনের বিভিন্ন সম্প্রদায়; 

চার্বাক দর্শনের উৎস যাই হোক না কেন এ হল সাধারণ লোকের বা জনসাধারনের দর্শন। সাধারণ লোক প্রত্যক্ষ লব্ধ জ্ঞানকেই সর্বাধিক মূল্য দেয়, দৈহিক সুখ ভোগকেই জীবনের পরম লক্ষ্য বলে মনে করেন। চার্বাক দর্শনে সাধারণ লোকের শ্রুতিমধুর কথা বলা হয় বলে এই দর্শনকে লোকায়ত দর্শন বলা হয়। চার্বাক দর্শনে ৩টি সম্প্রদায় আছে। যথা – ১. বৈতন্ডিক চার্বাক সম্প্রদায়। ২. ধূর্ত চার্বাক সম্প্রদায়। ৩. সুশিক্ষিত চার্বাক সম্প্রদায় । 

▪ বৈতন্ডিক চার্বাক সম্প্রদায়ঃ এই সম্প্রদায় ভুক্ত চার্বাকদের গঠন মূলক কোনো কাজ নেই এরা কেবল বিতন্ডা করেন। এদের নিজ্বস্ব কোনো মতামত নেই। এরা অপ্রত্যক্ষের বিষয়, ঈশ্বর , পরলোক প্রভৃতিকে যেমন অস্বীকার করেন, তেমনই প্রত্যক্ষের প্রামান্য অস্বীকার করেন। এরা সবকিছুতেই সংশয় প্রকাশ করেন। অনেকে বলেন এরা আসলে আদি চার্বাক। 

 ▪ ধূর্ত চার্বাক সম্প্রদায়ঃ এই সম্প্রদায়ভুক্ত চার্বাকদের মত প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ, অনুমান প্রমাণ নয়, জড়বস্তুই পরম সত্য, ইন্দিয় সুখই একমাত্র কাম্য। এরা ঈশ্বর , পুনজন্ম, পরলোক মানেন না। দৈহিক সুখ তা ক্ষণিক হলেও স্বর্গসুখের সমান, কন্টকাদি ব্যাথাজনিত দুঃখই নরক। এরা উচ্ছেদবাদী দেহাত্মবাদী ইত্যাদি নামেও পরিচিত। চার্বাক দর্শনের এই ধূত সম্প্রদায় সর্বজন পরিচিত ও বহুনিন্দিত। 

▪ সুশিক্ষিত চার্বাকঃ এই সম্প্রদায় প্রয়োজন বোধ অনুমানকে প্রমাণ রূপে স্বীকার করেন এদের কেউ দেহের পরিবর্তে ইন্দ্রিয়কে ,কেউ মনকে, কেউ আকার ও প্রাণকে আত্মা বলেছেন। এরা মানসিক সুখকে দৈহিক সুখের উপড়ে এবং গোষ্ঠী সুখকে আত্ম সুখের উপড়ে স্থান দিয়েছেন। দক্ষিনারঞ্জন শাস্ত্রী ‘চার্বাক দর্শন’ গ্রন্থে সুশিক্ষিত চার্বাক সম্প্রদায়কে কিছুটা আধ্যাত্মবাদের লক্ষ্যণ যুক্ত বলেছেন। 

▪ চার্বাক দর্শনকে লোকায়ত দর্শন বলা হয় কেন? 

সাধারণ মানুষের জীবনে উচ্চ আধ্যাত্মিক জ্ঞানের বিশেষ কোনো প্রয়োজন নেই এবং সাধারণ মানুষের জীবনে অর্থ এবং ইন্দ্রিয় বা জাগতিক সুখ-ই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়। অন্যদিকে চার্বাক দর্শনেও সেই অতিন্দ্রিয় অর্থাৎ ঈশ্বর,পরলোক, আত্মা এই সমস্ত জিনিস বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ইন্দ্রিয় বা জাগতিক সুখ-ই একমাত্র কাম্যবস্তু হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় বা বলতে গেলে চার্বাক দর্শনে সাধারণ মানুষের ভাবধারা ব্যক্ত হওয়ায় চার্বাক দর্শনকে লোকায়ত দর্শন বলা হয়। 

▪ চার্বাক দার্শনিকদের যদৃচ্ছাবাদ / স্বভাববাদ বা ভূতচতুষ্টবাদ :-

দর্শনে প্রকৃত বা যথার্থ জ্ঞানকে বলা হয় প্রমা এবং সেই প্রকৃত জ্ঞান লাভের মাধ্যম বা উপায়কে বলা হয় প্রমাণ। চার্বাকরা বলেন প্রত্যক্ষই হলো একমাত্র প্রমাণ। এবার চার্বাক দার্শনিকরা ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল) তেজ (অগ্নি) এবং মুরৎ (বায়ু) এই চারটি মহাভূতের অস্তিত্ব স্বীকার করেন। যেহেতু অর্থাৎ ব্যোম (আকাশ) প্রত্যক্ষ গচর নয় সেই কারণে তারা এই পঞ্চভূতের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। চার্বাক দার্শনিকদের মতে আমাদের এই বস্তু জগত সৃষ্টির পেছনে কোনো অতীন্দ্রিয় সত্ত্বা বা ঈশ্বরের হাত নেই। আমাদের এই জগত সৃষ্টি হয়েছে চতুর্ভুতের যদৃচ্ছাবাদ / স্বভাববাদের কারণে। চার্বাক দার্শনিকদের মতে ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল) তেজ (অগ্নি) এবং মুরৎ (বায়ু) এই চারটি মহাভূত যখন নিজেদের অন্তর্নিহিত স্বভাব ধর্মবশত উদ্দেশ্যহীন ভাবে বা খামখেয়ালি ভাবে পরস্পর মিলিত হয় বা ক্রিয়া করে,তখন বিভিন্ন বস্তু বা এই বস্তু জগতের সৃষ্টি হয়। জগতের সৃষ্টি সম্পর্কে চার্বাক দার্শনিকদের এই মতবাদ যদৃচ্ছাবাদ / স্বভাববাদ নামে পরিচিত। 

▪ চার্বাক দর্শনকে জড়বাদী দর্শন বলা হয় কেন?

চার্বাকরা হলেন নাস্তিক এবং জড়বাদী দার্শনিক। নাস্তিক হওয়ায় চার্বাকরা এই জগতের সৃষ্টির পেছনে কোনো অতিন্দ্রিয় সত্তা বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না আর নাতো তারা স্বর্গ, নরক পরলোকে বিশ্বাসী। অন্যদিকে চার্বাকরা মনে করেন অগ্নি, বায়ু, জল এবং মাটি অর্থাৎ এই চারটি মহা ভূতের অন্তর্নিহিত স্বভাবের ফলে এবং তাদের ক্রিয়ার ফলেই এই বস্তু বা জড় জগতের সৃষ্টি হয়েছে। সেই কারণে চার্বাক দর্শনকে জড়বাদী দর্শন বলা হয়।।

---